রাজা মিলিন্দ এবং বৌদ্ধ ধর্মে তার অবদান
-অমিতানন্দ ভিক্ষু
মিলিন্দ প্রশ্ন মতে, রাজা মিলিন্দের জন্ম হয় আলাসান্দ্রার কালাসি নামক গ্রামে। উক্ত স্থান বর্তমানে আফগানিস্থানের কান্দাহারে। ওনার রাজধানী ছিল সালাগায়, যেটি বর্তমান ভারতের পাঞ্জাবে। মিলিন্দ ছিলেন ইন্দো-গ্রীক রাজা (সম্ভবত বুদ্ধাব্দ ১৬৫ বা ১৫৫-১৩০) যিনি দক্ষিণ এশিয়াতে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্টপোষকতা করেন। মিলিন্দ কোকাসাসে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাক্ট্রিয়ার রাজা হন। ভারত মহাদেশে ওনার সাম্রাজ্যর পরিমাণ ছিল পশ্চিমের বর্তমান আফগানিস্থানের কাবুল নদীর উপত্যকা থেকে পূর্বের রবি নদীর উপত্যকা পর্যন্ত, উত্তরের শোয়াত নদীর উপত্যকা থেকে হ্যামল্যান্ড প্রদেশ পর্যন্ত। প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ মনে করেন তিনি অ্যালেকজান্ডার থেকেও বেশি প্রদেশ জয় করেন, যেমন রাজস্থান আর পাটলিপুত্রের অভিযান।
সম্রাট অশোকের পর বৌদ্ধ ধর্মের মশাল উজ্জীবিত রাখেন রাজা মিলিন্দ। মৌর্য সাম্রাজ্যর অবসানের পর অধিরাজত্ব আসে গ্রীকদের হাতে। বৌদ্ধ ধর্মে মিলিন্দ সর্বাপেক্ষা পরিচিতি লাভ করেন মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থের দ্বারা। মিলিন্দ নামটি আসে গ্রীক শব্দ মেনান্দ্রস থেকে। সেমেন্দ্রার অবদান কল্পতা, খারস্থি ও তিব্বতের তাঞ্জুর গ্রন্থের মতে তার নাম ছিল মিলিন্দ্রা। গ্রীক ইতিহাসবিদ স্রাবো প্লুটার্চ ও জাস্টিনের মতে, এমনকি মিলিন্দের ছাপানো কয়েনে তার নাম ব্যাসিলেয়াস সোটেরস মেনান্দ্রস হিসেবে উল্লেখ আছে যা ২২ টি বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে যেমন, কাবুল ও সিন্ধু উপত্যকা এবং উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে।
মিলিন্দ প্রশ্ন ও রাজা মিলিন্দের বৌদ্ধ শাসনে পৃষ্টপোষকতাঃ
মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থের সাল নির্ধারণ করা হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০০-২০০ তে। এই গ্রন্থটি বার্মার ৫ম ও ষষ্ঠ সঙ্গীতির মাধ্যমে খুদ্দক নিকায়ের অংশ হিসেবে যুক্ত করা হয়, যা শ্রীলংকা বা থাইল্যান্ডের ত্রিপিটকে পাওয়া যায় না। ধারনা করা হয় গ্রন্থটি লিখিত হয় সংস্কৃত ভাষায়, যদিও এখন শ্রীলংকার পালি ভার্সন ছাড়া অন্য কোন ভাষায় এই গ্রন্থ পাওয়া যায় না। চীনা ভাষায় ও এই গ্রন্থটি ভাষান্তর করা হয়েছিল যদিও সংক্ষেপিত রূপে। প্রাচীন পালি পাণ্ডুলিপি ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে কপি করা হয়। বিখ্যাত বৌদ্ধ লেখক রিচ ডেভিস বলেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যাতে প্রাচীন ভারতীয় গদ্যর উল্লেখ পাওয়া যায়। বুদ্ধের পরিনির্বাণের ৫০০ বছর পর মিলিন্দর জন্ম হয়, একথা প্রমাণিত হয় কারণ মিলিন্দ প্রশ্ন শুরু হয়, “পারিনিব্বানাতো পাঞ্চাঅয়াসসাসাতে আতিককান্তে” রাজা মিলিন্দ অত্যন্ত সশিক্ষিত এবং একজন ভালো তার্কিক ও ছিলেন। রাজা মিলিন্দ ভান্তে নাগসেন এর দেখা হবার অনেক পূর্ব থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের মূল খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
ভান্তে নাগসেনের সাথে দেখা হবার পূর্বে যখন কেউই রাজা মিলিন্দের বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে সঠিক কোন ধারনা দিতে পারছিলনা, সেই মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, “হায়! সম্পূর্ণ ভারত জ্ঞানী শূন্য যে এমন কোন সাধক বা ব্রাহ্মণ আছে যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে”। একদিন তিনি ভান্তে নাগসেনকে ভিক্ষানে যেতে দেখে তার সৌম্য চেহারা ও চালচলন দেখে মুগ্ধ হন। বুঝতে পেরেছিলেন এই ব্যক্তি জ্ঞানী না হয়ে যায় না। রাজা মিলিন্দ ভান্তে নাগসেনকে নিজ প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান এবং বৌদ্ধ বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্ন করেন, ভান্তে নাগসেন সকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দেন, যা আমরা বর্তমানে মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থ রূপে পাই। সেই থেকে মিলিন্দ রাজা বৌদ্ধ ধর্মের শরণ গ্রহণ করেন এবং প্রথম বিহার হিসেবে ভান্তে নাগসেনকে “মিলিন্দ বিহার” দান করেন। পরবর্তীতে আরও বহু বিহার ও বৌদ্ধ শাসনের জন্য আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করেন।
রাজা মিলিন্দের কয়েনঃ
বিভিন্ন স্থানে খননের পর বিভিন্ন আকৃতি ও ধরনের কয়েন পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একটিতে ধর্মচক্র খচিত। ধারনা করা যায় মিলিন্দের বৌদ্ধ ধর্মে অনুপ্রবেশের পর এই কয়েন তৈরি করা হয়। কয়েনটি ব্রোঞ্জের তৈরি যেখানে আয অষ্টাঙ্গিক মার্গের আটটি শলাকা আছে। এটা ছাড়াও তক্ষশিলা জাদুঘর, যেটি বর্তমান পাকিস্তানে, সেখানে সিল্ভার কয়েন সংরক্ষিত আছে, যেটি সম্ভবত ১৫৫-১৩০ বুদ্ধাব্দের। আরেকটি সিল্ভার কয়েন আছে ব্রিটিশ জাদুঘরে। Attic Tetradrachm of Menander যেটা গ্রীক-বাক্ট্রিয়ান স্টাইল, সংরক্ষিত আছে আলেকজান্দ্রিয়া-কাপিসা জাদুঘরে। একটি ছোট মূর্তি সংরক্ষিত(২য় শতাব্দীর) আছে কলকাতা জাদুঘরে, তবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না মিলিন্দের কিনা, তবে ইতিহাসবিদগণ ধরে নিয়েছেন রাজা মিলিন্দের হতে পারে, যেটার মধ্যে তরবারিতে ত্রিরত্ন প্রতীক দেখা যাচ্ছে।
রাজা মিলিন্দের মৃত্যুঃ
রাজা মিলিন্দের মৃত্যু সম্ভবত ১৩০ খ্রিষ্টপূর্ব । ওনার মৃত্যুর পর দেহভস্ম দিয়ে স্তুপা তৈরি করা হয়। ওনার মৃত্যুর পর ওনার স্ত্রী রানি আগাথোক্লেইয়া সিংহাসনে আরোপণ করেন। ইতিহাসবিদ স্রাবো প্লুটার্চ মনে করেন ওনার মৃত্যু হয় কোন এক সেনা অভিযানের সময়।
রাজা মিলিন্দের বৌদ্ধ ধর্মে প্রসারতার জন্য তিনি সম্রাট অশোকের পর স্থান করে নিয়েছিলেন। সম্রাট অশোকের ন্যায় ওনার কার্যক্রমের তথ্য বিশদ না হলেও বৌদ্ধ জাতির কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তথ্যসূত্রঃ
Bapat, P.V, “2500 Years of Buddhism” The Publications Division, Delhi; 1956
Pesala, Bhikkhu, “The Debate of King Milinda” Inward Path, Penang; 2001
http://en.wikipedia.org/wiki/Menander_I
http://en.wikipedia.org/wiki/Milinda_Panha